৬ এমইপির চিঠি ‘ভুয়া তথ্যের’ ভিত্তিতে: বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ইন ইউরোপ

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার’ আহ্বান জানিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের চিঠি লেখার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এসেছে ইউরোপ প্রবাসী তিন শতাধিক বাংলাদেশির তরফ থেকে।

ইউরোপভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইউরেপোর্টার জানিয়েছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ইন ইউরোপ’ সম্প্রতি ওই প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলকে, যেখানে ছয় এমইপির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিশদ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে।

জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে জোসেপ বোরেলকে চিঠি দিয়ে ছয় এমইপি বাংলাদেশের ওপর ‘অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ’ প্রয়োগের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ইন ইউরোপ’ এর চিঠিতে।

ছয় এমইপির ওই পদক্ষেপকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠনটি দেখছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে ‘ওকালতি’ হিসেবে, যিনি দুর্নীতির দায়ে কারাগারে গিয়েছিলেন, পরে মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাজা স্থগিত করে তাকে সাময়িক মুক্তি দেন।

জোসেপ বোরেলকে পাঠানো চিঠিতে যারা সই করেছেন, তাদের মধ্যে আছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী গবেষক মাজহারুল ইসলাম রানা, জার্মানি প্রবাসী সাংবাদিক সরাফ আহমেদ, প্রকৌশলী অনীল দাস গুপ্ত, ফ্রান্স প্রবাসী মাইম শিল্পী পার্থ প্রতিম মজুমদার, অস্ট্রিয়া প্রবাসী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. শহীদ হোসেন, ফ্রান্স প্রবাসী অধ্যাপক সোহেলা পারভীন শোভা।

এছাড়া বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল, চেক প্রজাতন্ত্র, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, স্পেন ও সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি আইনজীবী, চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীরা রয়েছেন স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে।

জোসেপ বোরেলকে লেখা চিঠিতে তারা দাবি করেছেন, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সরকারকে নিয়ে যেসব অভিযোগ ছয় এমইপির চিঠিতে এসেছে, সেসব ‘ভুয়া এবং অসত্য’, সেখানে বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ওই ছয় সদস্য হলেন– স্লোভাকিয়ার ইভান স্টেফানেচ, চেক প্রজাতন্ত্রের মিকেইলা সোয়জভা, বুলগেরিয়ার আন্দ্রে কোভাচেভ, ডেনমার্কের কারেন মেলচিয়র, স্পেনের হ্যাভিয়ের নার্ত এবং ফিনল্যান্ডের হেইডি হাউটালা।

তাদের মধ্যে তিনজন ইউরোপীয় পিপলস পার্টি, দুজন রিনিউ ইউরোপ এবং একজন গ্রিন পার্টির সদস্য।

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ছয় এমইপির চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার নাগরিকদের ‘গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে’ এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রতি ‘সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে’।

ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা মামলা দায়ের, নির্যাতন, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ঘটানো হচ্ছে বলেও সেখানে অভিযোগ করা হয়।

গত দুটি নির্বাচনে ‘জালিয়াতি ও কারচুপির’ অভিযোগ তুলে ধরে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগ চাওয়া হয় এমইপিদের চিঠিতে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার কথাও বলা হয় সেখানে।

সরকারের বিরুদ্ধে এমইপিদের আনা অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ইন ইউরোপ’ এর চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যা ও গুম’ শুরু হয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সময়, যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনার পর ক্ষমতায় বসেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বরাত দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিঠিতে বলা হয়, জিয়ার সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর হাজারের বেশি সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলেও বিরোধীদলের নেতা-কর্মী, সাংবাদিক, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ওপর ‘নির্যাতন, অপহরণ, গুম ও হত্যা অব্যাহত ছিল’।

২০০৪ সালে বিএনপির সময়ই যে র‌্যাব গঠিত হয়েছিল, সে কথা তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, ওই বছরের জুলাই থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবরের মধ্যে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ‘হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন’ করা হয় এবং তাদের মধ্যে ১৫০০ জনকে ‘ক্রসফায়ারের নামে হত্যা’ করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-জামায়াত জোট ‘ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে’। তারা শত শত গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তাদের পেট্রোল বোমা, হাতবোমায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২০ জনসহ অন্তত ২০০ জনের মৃত্যৃ হয়।

পরেরবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট হাতে গোণা কয়েকটি আসন পায়। এমইপিরা তাদের চিঠিতে ওই ভোটকে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ আখ্যায়িত করেছিলেন।

সে প্রসঙ্গ ধরে ‘বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ইন ইউরোপ’ এর চিঠিতে বলা হয়, ভোটের আগের রাগেই ফল নির্ধারণের ‘একটি মিথ্যা গুজবের ভিত্তিতে’ এমইপিরা ওই মন্তব্য করেছেন।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের এ সংগঠন বলছে, বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে বাংলাদেশে আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের কী দশা হয়েছিল, তা আগে এমইপিদের জানা উচিত।

ওই সময়ই যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পাঁচবার ‘দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছিল এবং ওই সময়ই যে দেশে ইসলামিক জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে, সে কথাও বলা হয় প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিঠিতে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও গবেষণা এবং উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ইইউ দেশগুলোর মধ্যে দীর্ঘ দিনের অংশীদারত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্কের কথা তুলে ধরে চিঠিতে বলা হয়, সকল ইইউ সদস্য রাষ্ট্র এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশের সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রভূত অগ্রগতি অর্জন করেছে। বিশ্ব ব্যাংকের সমৃদ্ধির সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে।

“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের পর্যায় থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি ‘উন্নত ও স্মার্ট’ জাতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।”

চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা বলছেন, যে বাংলাদেশকে একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হত, সেই বাংলাদেশই এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসাবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ এবং ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের যে পরামর্শ এমইপিরা দিয়েছে, তাকে ‘ভালো কূটনৈতিক সমাধান বলা যায় না’।

“এই ধরনের নীতি হলে তা কেবল শান্তিপ্রিয় একটি জাতির ক্ষতিই করবে,” বলা হয়েছে তাদের চিঠিতে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।